ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ
অঙ্কন : পার্থ দে
অঙ্কন : পার্থ দে
আবেগের, উচ্ছাসের বাস্পে অস্পষ্ট করে নয়, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গীর নির্ভরে, ক্ষুরধার যুক্তির বিশ্লেষণে এবং অত্যন্ত নির্মোহ ভঙ্গীতে ষাট ছুঁই-ছুঁই প্রশান্তকুমার পাল, তাঁর রবিজীবনীতে আবিষ্কার করে চলেছেন মানুষ রবীন্দ্রনাথকে। ১৯৮২-তে রবিজীবনী’র প্রথমখণ্ড প্রকাশিত হয়। প্রকাশ হওয়ামাত্র এই বই আলোড়োন তোলে। এই জীবনীর পরবর্তী খণ্ডগুলিও আদৃত হয় পাঠক সমাজে। শান্তিকেতনে বিশ্বভারতীতে কর্মরত শ্রী পাল সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন। সেই সময়েই সংবাদ প্রতিদিন-এর পক্ষ থেকে আশোককুমার মুখোপাধ্যায় এই খোলামেলা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবনী রচনার কাজ আপনি হাতে নিলেন কেন? বিশেষত, যখন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের চার খণ্ডের রবীন্দ্রজীবন ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক নামক বিখ্যাত গ্রন্থটি রয়েছে ?
রবীন্দ্রনাথের জীবনী লিখব এমন ভাবনা আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যখন কালানুক্রমিকভাবে চিঠিপত্র-সহ সমগ্র রবীন্দ্ররচনা পড়তে শুরু করি, মনের সুদূর প্রান্তেও ছিল না। আমার বাড়তি এনার্জি খরচ করবার জন্য সুবিনয় রায়ের কাছে গান শিখেছি। বহুরূপীতে গিয়েছিলাম শম্ভু মিত্রের কাছে অভিনয় শিখতে। এছাড়া ছোটোবেলা থেকেই আমার বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দিকে ঝোঁক। আমি রেডিও বানাতাম, টি.ভি সারাতাম। কাঁকিনাড়ার বাড়ির ইলেকট্রিক তার ও অন্যান্য সরঞ্জাম, নিজে বসিয়েছি। নতুন জিনিসের প্রতি আমার বরাবরের আগ্রহ। এখন যেমন, কম্পিউটারে লিখি। রবীন্দ্রনাথের জীবনচর্চার শুরু আমার এই নতুনের প্রতি আগ্রহ থেকে।
হল কি, আনন্দোমোহন কলেজে যখন পড়াতে ঢুকলাম, আমার সন্ধেবেলার সময়টা গ্রাস করে নিল কলেজ। গান শেখা, অভিনয় করা বন্ধ। কিন্তু নতুন কিছু করতে হবে। শুরু করলাম রবীন্দ্ররচনা পাঠ। পড়ার সুবিধের জন্য প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের চার খন্ডের রবীন্দ্রজীবন ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক এবং অন্যান্য কয়েকটি বই অবলম্বনে পাঠসূচীর একটি রূপরেখা ঠিক করে নিয়েছিলাম। কিন্তু পাঠ যতই এগোতে থাকলো রূপরেখার অসম্পূর্ণতা ও নানান সমস্যা ততই প্রকট হয়ে উঠতে লাগল। দেখা গেল, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বইতে নানা অসঙ্গতি। সাল, তারিখ নিয়ে নানান বিভ্রান্তি। এর ফলে পাঠকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে হল পাঠাগারে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নোট রেখে যাচ্ছিলাম। ১৯৭৬-এর শেষভাগে রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার সৃষ্টি পথ রেখেছ আকীর্ণ করি / বিচিত্র ছলনাজালে’ কবিতায় এসে পৌঁছলাম তখন দেখা গেল আমার খাতায় প্রচুর অপ্রকাশিত ও অব্যাবহৃত তথ্য। এবং খাতা জমেছে প্রচুর। এই খাতাগুলো হয়তো একদিন ওজন দরেই বিক্রি হয়ে যেত যদি না বন্ধুবর অধ্যাপক অরূপরতন ভট্টাচার্য হস্তক্ষেপ করতেন। অরূপ ক্রমাগত তাড়া দিয়ে আমাকে রবীন্দ্রনাথের জীবনী রচনার দুঃসাধ্য কাজে লাগালেন। ১২৬৮ থেকে ১২৮০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত রবীন্দ্রজীবনের প্রথম তের বছরের খসড়া বিবরণ যখন লেখা শেষ হয়, তখন অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে কবি অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের কাছে তা দিয়ে আসি। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ বিস্মিত করে যথেষ্ট উৎসাহ দেন। আমার বই রবিজীবনী-র নামকরণও তাঁরই করা।
রবীন্দ্রজীবনী লিখতে গিয়ে আপনি কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে চলেছেন?
জীবনীসাহিত্য রচনার নানান ধরন চালু আছে। আমি যখন লিখতে শুরু করি নির্সিষ্টভাবে কোন প্রচলিত ধরন মানিনি। চেষ্টা করেছিলাম, সমসাময়িক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে জানতে। মনে হয়েছিল, এভাবেই রবীন্দ্রনাথের জীবনকে ভালভাবে বুঝতে পারব। সেজন্যই রবীন্দ্রনাথের জীবনী রচনার কাজে ‘সমকাল’ আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রবীজীবনী লেখার শুরুতেই ‘পূর্বকথন’ অংশে ঠাকুর বংশের ও দেশকালের পরিচয় দেবার পর ‘জীবনকথা’ বর্ণনা করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রতিটি বছরের কালসীমায় এক-একটি অধ্যায়কে বিন্যস্ত করে। আমি এক্ষেত্রে বাংলা সালকেই গ্রহণ করেছিলাম। যেমন রবীন্দ্রজীবনের প্রথম বছর ১২৬৮, দ্বিতীয় বছর ১২৬৯ ইত্যাদি।
রবীন্দ্রজীবনী রচনার উপকরণ হিসেবে ঠাকুরবাড়ির হিসেবের খাতা ‘ক্যাশ বহি’-র এমন ব্যাপক ব্যবহারে সম্ভবত আপনার আগে কেউ করেনি। এই ক্যাশ বইয়ের সাহায্যে আপনি প্রচলিত ধারনাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন, অনেক অস্পষ্ট বর্ণনাকে স্পষ্ট করেছেন। এই ক্যাশবহি’র সন্ধান আপনি কোথায় পেলেন এবং এর ফলে আপনার রচনা কতটা পূর্ণতা পেল?
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পারিবারিক হিসেবের খাতাগুলি-যেগুলি সাংসারিক খরচের বিভিন্ন খুঁটিনাটি তথ্যে পরিপূর্ণ রবীন্দ্রনাথের রচনার একটি মূল্যবান উপকরণ। জোড়াসাঁকোর বাড়ির একতলায় জমিদারি কাছারি–এই খাতাগুলি সেখানকার কর্মচারীরা লিখেছেন। প্রতি বাংলা নববর্ষে শুধু পারিবারিক হিসেব রাখার জন্যই একাধিক খাতার সূচনা করা হত এবং প্রায় প্রতিদিন বাংলা তারিখ, বার ও ইংরেজি তারিখ দিয়ে বিভিন্ন খাতে খরচের হিসেব যথাসম্ভব বর্ণনা দিয়ে লেখা হত। দেবেন্দ্রনাথের ছেলেদের মধ্যেই কেউ হিসেবগুলি পরীক্ষা করে ‘ক্যাশ বহি’-র প্রতি পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর করতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য দু-এক বছরের খাতা পাওয়া যায়নি- কিন্তু যা পাওয়া গেছে তাও কম নয়। শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে ছোটোবড় মিলিয়ে এইরকম খাতা বা ফাইল আছে প্রায় সাড়ে তিনশ- যার শুরু ১২৬৭-৬৯ বঙ্গাব্দের ‘এস্টেটের হিসেব বহি’ দিয়ে, শেষ হয়েছে ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ‘কালিম্পঙের ক্যাশ বহি’তে। এইসব হিসেবের খাতাগুলি থেকে আমরা রবীন্দ্রজীবনীতে বহু নতুন তথ্য যোগ করতে পারি, বহু তথ্য সংশোধন করতে পারি ও বহু তথ্যের যথাযথ স্থান-কাল নির্দেশ করতে পারি।
যেমন রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, ছেলেবেলা এবং কিছু প্রচলিত রচনা পড়ে আমাদের ধারণা ছিল যে তাঁর ইস্কুল-জীবনের সূচনা হয়েছিল ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। ক্যাশবহি’র সাক্ষ্য কিন্তু অন্য কথা বলে। দেখা যায়, তিনি ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে নয়, ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতা ট্রেনিং একাডেমি’তে যার তৎকালীন ঠিকান ছিল ১৩নং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট। বর্তমানে স্কুলটি ১৩ নং ডঃ নারায়ণ রায় সরণি ঠিকানায় শ্রীমানী বাজারের ঠিক পিছনে অবস্থিত। এমনভাবেই ক্যাশবই থেকেই পাওয়া গেছে, রবীন্দ্রনাথের পাওয়া নোবেল প্রাইজের সঠিক অঙ্কটি। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন, আরও অন্যান্য অনেকে লিখেছেন, নোবেল প্রাইজের আর্থিক মুল্য ছিল এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা। ক্যাশ বইয়ের হিসেব অনুযায়ী তা ছিল এক লক্ষ ষোল হাজার টাকা। এভাবেই রবীন্দ্র জীবনীর নানান উপকরণকে জড়ো করে, তার সঙ্গে নিজের বিচার বিশ্লেষণকে লাগিয়ে রবীন্দ্রজীবনের বছরগুলিকে এক একটি করে পেরিয়ে চলেছি।
ছেলেবেলা প্রসঙ্গে আর একটি কথা। শৈশবে পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁদের দৈন্যদশার কথা রবীন্দ্রনাথ বহুবার লিখেছেন। কিন্তু ‘ক্যাশ বহি’-র নির্ভরে আপনি দেখিয়েছেন তেমন হতদরিদ্র অবস্থা মোটেই ছিল না বালক রবীন্দ্রনাথের। দুয়েকটি উদাহরণ দেবেন, এই প্রসঙ্গে।
হ্যাঁ এটা ঠিক জীবনস্মৃতি, ছেলেবেলা প্রভৃতি স্মৃতিকথামূলক রচনায় পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির ব্যাপারে তাঁদের দৈন্যদশার কথা রবীন্দ্রনাথ বহুবার বহুভাবে লিখেছেন। কিন্তু ক্যাশবহিগুলি থেকে আমরা অন্যরকম চিত্র পাই। ২৪ পৌষ ১২৭১ (শুক্র ৬ জানুয়ারী ১৮৬৫) ‘রবীন্দ্রবাবু’র ইজের ১২টা বারো আনাতে যেমন কেনা হয়েছে তেমন ১৪ অগ্রহায়ণ (সোম ২৮ নভেম্বর ১৮৬৪) ‘রবিন্দ্রবাবু’র ১২ টা ইজের তৈরি করতে তিন টাকা পনের আনাও খরচ করা হয়েছে। আবার ৮ বৈশাখ ১২৭২ (বুধ ১৯ এপ্রিল ১৮৬৫) রবিন্দ্রবাবুর পিরান ১২টা – খাতে দু’টাকা দশ আনা ব্যয় হলেও ১৮ চৈত্র ১২৭১ (বৃহ ৩০ মার্চ ১৮৬৫) ‘রবীন্দ্রনাথ বাবু’র ১২ টা ‘পিরান’-খাতে খরচের পরিমাণ পাঁচ টাকা সাড়ে পাঁচ আনা। জামা এবং প্যান্টের কাপড়ের গুণগত মান সম্পর্কে আমাদের কিছু বলা সম্ভব না হলেও, একই সংখ্যক ইজের এবং পিরানের দামের পার্থক্যটুকু বুঝিয়ে দেয় আটপৌরে ও পোশাকী দু’রকমের জামা কাপড়ের আয়োজন তাঁর জন্যে ছিল এবং যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল।
এই হিসাবগুলি রবীন্দ্রনাথের নিতান্ত শৈশবের, চার পাঁচ বছরের হলেও, এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে, পরবর্তীকালে অবস্থার কিছু অবনতি হয়েছে। একই ধরনের হিসেব আমরা পরের বছরগুলিতেও দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘আমদের চটিজুতা একজোড়া থাকিত, কি পা দুটা যেখানে থাকিত সেখানে নহে। প্রতি পদক্ষেপে তাহাদিগকে আগে আগে নিক্ষেপ করিয়া চলিতাম- তাহাতে যাতায়াতের সময় পদচালনা অপেক্ষা জুতাচালনা এত বাহুল্য পরিমাণে হইত যে পাদুকা সৃষ্টির উদ্দেশ্য পদে পদে ব্যর্থ হইয়া যাই।’ কিন্তু এক জোড়া মাত্র ‘চটিজুতা’ নয় হাপচটী, চটীবিনামা, বিনামা প্রভৃতি আখ্যায় যে-পরিমাণ জুতো রবীন্দ্রনাথের জন্যে কেনা হয়েছে, তার হিসেব নিলে প্রশ্ন জাগতে পারে, যাঁদের বাইরের জগতে যাতায়াত অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল তাঁরা এত জুতো নিয়ে কি করতেন। ‘জীবনস্মৃতি’র আর একটি মন্তব্যেরও- ‘বয়স দশের কোঠা পার হইবার পূর্বে কোনদিন কোন কারণেই মোজা পরি নাই’–বিরোধিতা করে ক্যাশবহিগুলি। হিসেবের খাতাগুলি থেকে জানা যায় ২৪ পৌষ, ১২৭১ (শুক্র ৬ জানুয়ারি ১৮৬৫) বালক রবীন্দ্রনাথের জন্য এক ডজন মোজা সাড়ে তিন টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে মিথ্যেবাদী প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মা’কে হারিয়েছিলেন অত্যন্ত কম বয়সে। সম্ভবত সেই কারণে তাঁর বাল্যজীবনে একটা বঞ্চনাবোধ ছিল। এই বঞ্চনাবোধ, একাকীত্বের কথা তাই জীবনস্মৃতিতে, ছেলেবেলায় এসেছে। জীবনস্মৃতি পড়তে গিয়ে কবির এই অনুভবনের কথা আমাদের যেমন মনে রাখতে হবে , তাঁর জীবনী রচনা করতে গিয়ে কোনটা গ্রহণ করব, কোনটা বর্জন করব তাও মাথায় রাখতে হবে।
হ্যাঁ গ্রহণ এবং বর্জন এই দুটি জিনিসই খুব মূল্যবান। জীবনী লিখতে গিয়ে আপনি নিশ্চই এহেন সমস্যায় পড়েছেন, যেখানে একই ঘটনার বিভিন্ন ভাষ্য আছে অথবা কোন রচনার তথ্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা আছে। সে অবস্থায় আপনার এই গ্রহন বর্জনের প্রক্রিয়াটি কেমন ভাবে কাজ করে?
গ্রহণ-বর্জনের ব্যাপারে আমি খুবই সতর্ক থাকি। একই ঘটনার বিভিন্ন ভাষ্য থাকলে সেক্ষেত্রে আমার চেষ্টা থাকে সেই বিষয়ে যথাসম্ভব তথ্য জোগাড় করবার। বিভিন্ন তথ্যের নিরিখে ঘটনাটিকে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করি। এমন করতে করতে কোন সময়ে অকাট্য প্রমাণ পেয়ে যাই যার ফলে একটা সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে যাকে বলে পাথুরে প্রমাণ, তেমনটা পাওয়া যায় না। হয়ত একই জিনিসের বিভিন্ন ভাষ্য বা ব্যাখ্যা আছে। তখন সবগুলিকেই পর পর সাজিয়ে দিই। কোন মন্তব্য করি না। বিভিন্ন ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে ঘটনাটি বোঝবার ভার পাঠকের ওপরেই ছেড়ে দিই। তাছাড়া উপায় নেই। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘ছবি’ কবিতা- তুমি কি কেবলই ছবি ? কেউ বলেছেন এটি উনি লিখেছেন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর কথা ভেবে আবার কেউ বলেছেন স্ত্রী মৃণালিনীদেবীকে মনে করে। আমি দুটো মতই রাখতে চাইব আমার বইয়ে, কোন মন্তব্য করব না।
কাদম্বরীদেবীর কথা মনে পড়ছে ওঁর আত্মহনন প্রসঙ্গ। এই প্রসঙ্গেও তো নানারকম ব্যখ্যা চালু আছে অবনীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা ভগিনী মৃনয়নী দেবী বলেছেন, পুলিশ এসে কাদম্বরী দেবীর মৃতদেহ নিয়ে যায় এবং ময়নাতদন্তে পাকস্থলীতে আফিম পাওয়া যায়। এমনকি, তাঁর মৃত্যু তারিখ নিয়েও তো একটা সংশয় আছে। সমকালীন কোন কাগজেও তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়নি। এর কারণ কি?
নানা কারণে এক ধরণের একাকীত্বের বোধ কাদম্বরীদেবীকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। এই অবস্থার মধ্যেই সামান্য কোন কথা কাটাকাটি বা অন্য কোন তুচ্ছ উপলক্ষ কাদম্বরীদেবীকে আত্মহত্যার নিদারুণ সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছিল। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু তারিখ লিখেছেন ৮ বৈশাখ ১২৯১। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির হিসেবের বইগুলি ভাল করে খুঁটিয়ে বিচার করে আমার ধারণা ৮ ও ৯ বৈশাখ দু’দিন ডাক্তাররা তাঁর জীবনরক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। এবং সম্ভবত ৯ বৈশাখ রাত্রে বা ১০ বৈশাখ সকালবেলায় তাঁর মৃত্যু হয়।
সুনয়নীদেবী যে বলেছেন পুলিশ এসে মৃতদেহ নিয়ে যায় এবং ময়নাতদন্তে পাকস্থলীতে আফিম পাওয়া যায় একথাও কিন্তু ক্যাশ বহি’র হিসেব অনুসায়ী মেলে না। অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে, পুলিশকে নিশ্চয়ই জানানো হয়েছিল। কিন্তু কাদম্বরীদেবীর মৃতদেহ মর্গে পাঠানো হয়নি। করোনার কোর্ট বসেছিল জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই। ওই সময়ে ১৪ বৈশাখ এবং ৩১ বৈশাখের হিসেব দুটিতে পাওয়া যাবে, ‘কাঁউসেনের ফি’, ‘কেমিকেল এগজামিনার আসায় গাড়ি ভাড়া’, ‘করোনারে ক্লার্কের গাড়ি ভাড়া’ এবং ’ওঁদের জন্য ব্রান্ডি কেনবার’ খরচের হিসাব ইত্যাদি। এসব থেকে প্রমাণ হয় যে করোনার কোর্ট বাড়িতেই বসেছিল। করোনার নিশ্চয়ই এই মৃত্যু সম্পর্কে কোন রিপোর্ট লিখেছিলেন। যা হয়ত আজও কোন সরকারি দপ্তরে রক্ষিত আছে। এই রিপোর্টটি উদ্ধার করতে পারলে কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু সম্পর্কে আরও নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে।
হ্যাঁ একথাটা ঠিক এবং আশ্চর্যের বিষয় সমকালীন যে-কটি পত্রিকা আমরা দেখবার সুযোগ পেয়েছি তার কোনটাতেই কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। এর কারণ কি তা তো আমি নির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারব না, তবে একথা নিশ্চিত বলা যায় কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু সংবাদ যাতে খবরের কাগজে না ছাপা হয় তার জন্য ঠাকুর বাড়ি থেকে ৫২ টাকা খরচা করা হয়েছিল। এবিষয়ে ২৮ জৈষ্ঠ ১২৯১ ক্যাশবহিতে একটি হিসাব দেখা যায় : ‘নূতন বধু ঠাকুরানীর (কাদম্বরীদেবী) মৃত্যু হওয়ার খবরের কাগজে উক্ত সম্বাদ নিবারণ করার জন্য ব্যয়… ৫২’ -এই কারণেই কোন সংবাদ প্রকাশিত হয়নি?
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব বিকাশে ঠাকুর পরিবারে কাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ?
প্রথমত তাঁর পিতৃদেব-মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ওপর দেবেন্দ্রনাথের এক অমোঘ প্রভাব ছিল। পিতা বেঁচে থাকাকালীন তাঁর আদেশে বা প্রভাবে এমন বহু কাজ রবীন্দ্রনাথ করেছেন, যাতে তাঁর মনের সায় ছিল না। দেখা যায় দেবেন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার আগের এবং পরের রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের ধরন দুটি বেশ আলাদা। দ্বিতীয়জন যিনি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে শিল্প ও সঙ্গীতবোধকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, তিনি নিঃসন্দেহে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। আর পৃথিবীর দিকে তাকানোর দৃষ্টি তিনি লাভ করেছিলেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। আমি যেভাবে যে ক্রম অনুসারে এই তিনজনের নাম বললাম, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব গঠনে এঁদের ভূমিকাও ঠিক এই ক্রমানুযায়ী বলেই আমার ধারণা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেবেন্দ্রনাথের তারপরেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এবং এর পরে সত্যেন্দ্রনাথ।
আপনি কিন্তু কাদম্বরীদেবীর নাম নিলেন না।
রবীন্দ্রনাথের জীবন গঠনে কাদম্বরীদেবীর সেইরকম অমোঘ প্রভাব আছে বলে আমার মনে হয় না। তিনি কবির সহমর্মী, ঠিক আছে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব গঠনে কাদম্বরীদেবীর কথা যেরকম গুরুত্ব দিয়ে বলা হয় তেমনটা নয় বোধ হয়। একথা যখন বলছি তখন কিন্তু আমি জানি কবির শেষ জীবনের রচনার অনেকটা জুড়ে আছে কাদম্বরীদেবীর স্মৃতি।
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে আপনার কখনও মনে হয়নি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্যক্ত রবীন্দ্রনাথের একটা গরমিল থেকে যাচ্ছে ? তাঁর রচনা পড়ে তাঁকে যেরকম অলৌকিক বলে মনে হয়, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ যেন ঠিক সেইরকম নন তাঁর মধ্যে কিছু পরিমাণে মানুষী দুর্বলতা আছে এবং মাঝে মধ্যে তিনি একটু কান-পাতলা, এমনটা মনে হয়নি আপনার?
কানপাতলা ! হ্যাঁ এটা মানতেই হবে। এমনটা ছিলেন বলেই তাঁর চারপাশে মাঝে-মধ্যে প্রচুর সুযোগ-সন্ধানী ভিড় করেছে। তাদের কথা শুনে তিনি অযথা ভাল লোককে শাস্তি দিয়েছেন। তথ্যনিষ্ঠ থাকতে হলে এইগুলিকে এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। কিন্তু মানুষ ছিলেন তো, তাই দুর্বলতা কিছু থাকবেই। সেগুলি আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। রবিজীবনীতে এমন ঘটনার উল্লেখও করা আছে।
অজিতকুমার চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে অত্যন্ত অল্প বেতনে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর ওপর দায়িত্ব ছিল মা সুশীলাদেবী এবং ভাইদের ভরণ-পোষণের। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের প্রশ্রয়ে অজিতকুমারের সঙ্গে ঢাকার উকিল বিভুচরণ গুহঠাকুরতার বালবিধবা বোন লাবণ্যরেখার মন বিনিময় হয়। তাঁদের বিবাহের ঠিক হয়। অজিতকুমারের মা সুশীলাদেবীর এই বিবাহে সম্মতি ছিল না, তিনি এজন্য রবীন্দ্রনাথকে দায়ী করেছিলেন। সুশীলাদেবী শান্তিনিকেতনে আশ্রমের ‘শিশুবিভাগের আহারাদি পর্যবেক্ষণে’র দায়িত্বে ছিলেন। অজিতকুমারের বিবাহ নিয়ে মনোমালিন্য হবার পরই দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ, সুশীলাদেবীর অসুস্থতা এবং বিদ্যালয়ের অসুবিধা এই দুই যুক্তিতে তাঁকে অব্যাহতি দিতে চাইছেন। ক্ষুদ্র, ক্ষোভ-দ্বন্ধে উর্ধ্বে ওঠার সাধনা ছিল রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু এই ছোটো ঘটনাগুলিই তাঁর মনুষ্য-স্বরূপকে চিনিয়ে দেয়। সুশীলাদেবীকে অব্যাহতি দিয়ে তিনি এই পদে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মা গিরিবালা দেবীকে আশ্রমে নিয়ে আসেন।
তাতার অনুরাগী পিয়ার্সনও সবসময় তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশিত ব্যবহার পাননি। পিয়ার্সন শিশুদের সঙ্গ খুবই ভালবাসতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বার বার সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন। ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা সফরে গেছেন। নিউইয়র্কে তাঁকে তিন মাস কাটাতে হয়েছে। কোন কাজ নেই সেরকম। পিয়ার্সন স্টার কমনওয়েলথ স্কুলের বাচ্চাদের দেখতে গেলেন। শিক্ষণ পদ্ধতিটিকে আগ্রহ সহকারে দেখলেন, বুঝলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে আবেদন করলেন একবারের জন্য ওখানে যাবার জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত কঠিনভাবে এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। পিয়ার্সনের মনোযোগ যে তাঁর থেকে অন্য কোন দিকে যাবে, এমনটা হয়ত তাঁর ভাল লাগেনি।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়া নিয়ে তো কিছুকাল আগে পর্যন্ত আমরা নানান বিতর্কিত মতামত শুনেছি। বিদেশের অ্যালেক্স অ্যারনসন আর আমাদের নিত্যপ্রিয় ঘোষ মনে করেন রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পাবার জন্য সুইডিশ রাজকুমারকে বশ করে তাঁর প্রভাব খাটাতে চেয়েছেন। আপনার কি ধারণা এই বিষয়ে?
নোবেল প্রাইজ পাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ আদৌ কোন প্রভাব খাটাননি। এই নিয়ে বিশদে অনেক কিছু বলা যায়। সংক্ষেপে ব্যাপারটা এইরকম। গ্রেট ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের সদস্য হিসেবে টমাস স্টার্জ মূর রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ দেবার সুপারিশ করে সুইডিশ অ্যাকাডেমির কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সেই সংক্ষিপ্ততম প্রস্তাবে রবীন্দ্রনাথের রচনা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটি শব্দও ছিল না, তবু সম্ভবত প্রস্তাবটির অভিনবত্বের কারণেই এটি সুইডিশ অ্যাকাদেমির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওই বছরে অর্থাৎ ১৯১৩ সালে পুরস্কারের জন্য সর্বমোট ২৮ জনের নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল। নোবেল কমিটির সদস্য অ্যাকাডেমিনিশয়ান পের হ্যালস্ট্রম-এর ওপর দায়িত্ব পড়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত প্রস্তাবটির গ্রহনযোগ্যতা বিচার করে একটি রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। হ্যালস্ট্রমের মতে গ্যেটের পরে রবীন্দ্রনাথের মত বড় মাপের কবি সারা ইউরোপের কোথাও জন্মাননি। কিন্তু হল্যাস্ট্রমের এই সপ্রশংস প্রতিবেদন নোবেল কমিটির সভাপতি হারাল্ড হেয়ার্ণের মন গলাতে পারেনি। তাঁর সভাপতিত্বে গঠিত নোবেল কমিটিতে পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথের নামে অনুমোদিত হয়নি।
নিয়ম এই যে, নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের প্রাপক নির্বাচনের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমির আঠারো জন আজীবন সদস্য মনোনীত হন। কোন একজনের মৃত্যু ঘটলে তাঁর জায়গায় আর-একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ১৯১৩ সালে সুইডিশ অকাডেমিতে এমন একজন ছিলেন যিনি বাংলা জানতেন। তিনি হলেন বৃদ্ধ প্রাচ্যবিদ এসাইয়াস হেনরিক ভিল্হেম্ টেগনার। কিন্তু তিনিও কমিটির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশপ, সরকারি কর্মচারি, লেখক প্রভৃতি নিয়ে গঠিত সুইডিশ অকাদেমির বিবেচনার্থে যখন নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তটি পেশ করা হল, তখন রবীন্দ্রনাথের সমর্থনে এগিয়ে এলেন সুইডেনের সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ কবি কার্ল গুস্তাফ ভার্নার ভন হাইডেনস্ট্যাম। ইনি রবীন্দ্রনাথের ইংরাজি গীতাঞ্জলী ও তার সুইডিশ অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন। তিনি রবীন্দ্রনাথের পক্ষ সমর্থন করে অকাদেমির সদস্যদের উদ্দেশ্য একটি অসাধারণ লেখা পাঠান যার মধ্যে বলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি আমাকে দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র আনন্দ দিয়েছে। মনে হয়েছে স্বচ্ছ ঝর্ণার পবিত্র টাটকা জল পান করছি। হাইডেনস্ট্যাম-এর লেখাও পের হ্যালস্ট্রমের প্রতিবেদন অকাডেমির সদস্যদের প্রভাবিত করে। এর ফলে দেখা যায় পুরস্কার প্রাপক নির্বাচনের জন্য যে তেরোজন ভোট দিয়েছেন, তার মধ্যে বারো জন দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে। এটা নিশ্চিত বলা যায়, পুরস্কার পাবার আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুইদিশ কবি হাইডেনস্ট্যামের কোন যোগাযোগ হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের জীবনী রচনা কত খণ্ডের মধ্যে শেষ করতে পারবেন বলে মনে হয়?
অন্তত বারোটা খণ্ড তো হবেই।
এ পর্যন্ত আপনার রবিজীবনীর ছ’টি খণ্ড বেরিয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত সপ্তম খণ্ডও প্রকাশিত হবে। সপ্তম খণ্ডে নতুন কিছু আলোকপাত করেছেন?
সপ্তম খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের ছাপান এবং আমেরিকা সফর প্রসঙ্গে অনেক তথ্য সাজিয়ে বিবরণীটিকে পূর্ণাঙ্গ করবার চেষ্টা করেছি। পরবর্তী খণ্ডগুলিতে এইগুলি আরও স্পষ্ট হবে, তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের বৃত্তান্তটি নানান অনুষঙ্গসহ আরও পূর্ণাঙ্গ, স্পষ্ট হয়ে উঠবে, এই আশা রাখি। এছাড়া এই খণ্ডে থাকছে রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড পাবার বিবরণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর রবীন্দ্রনাথকে নাইটহুড দেবার সিদ্ধান্ত বৃটিশদের একটি রাজনৈতিক চাল। তাদের মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে নাইটহুড দিলে বাঙালি তথা ভারতবাসী খুশি হবে। ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ প্রস্তাব করলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নাইটহুড নেবেন কি না এব্যাপারে তাঁর সন্দেহ ছিল। অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে হার্ডিঞ্জ-এর বন্ধুত্ব ছিল। এর আগে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের স্কুলের ওপর সরকারি নিশেধাজ্ঞা ছিল। সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ওই স্কুলে পড়াতে পারবেন না। হার্ডিঞ্জ-এর চেষ্টায় এই নিশেধাজ্ঞা উঠে যায়। হার্ডিঞ্জ-এর সেক্রেটারি অ্যান্ড্রুজকে লিখলেন যে রবীন্দ্রনাথকে নাইটহুড দেওয়া হলে ওঁর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা একটু ‘সাউন্ড’ করে দেখতে। এরপরের ঘটনা তো সবার জানা। ১৯১৫-র ৩ জুন রবীন্দ্রনাথকে নাইটহুড দেওয়া হয়।
গত পঁচিশ বছর ধরে আপনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঘর করছেন। এর ফলে, আপনার কোন প্রকৃতিগত পরিবর্তন হয়েছে, টের পান?
হ্যাঁ আগে রগচটা ছিলাম এখন একটু ঠান্ডা হয়ে গিয়েছি। আর কেউ নয় স্বয়ং আমার স্ত্রী দিয়েছেন এই সার্টিফিকেট। উনি জিজ্ঞেস করছিলেন যে কি করে আমার এমন পরিবর্তন হল। আমি বললাম, শান্তিনিকেতনে যাঁকে নিয়ে ঘর করছি তাঁর প্রভাবেই বোধহয় এমনটা হল। স্ত্রী প্রথমে ভেবেছিলেন আমি বোধহয় অন্য কোন মহিলার সঙ্গটঙ্গ করছি। পরে রবীন্দ্রনাথের কথা বলাতে আশ্বস্ত হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের কোন সত্তাটি আপনার কাছে আকর্ষক মনে হয়?
আমার কাছে কবি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে কর্মী রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি আকর্ষক। আমার কিরকম মনে হয়, বেশ কিছুকাল পরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা হয়ত তেমনভাবে থাকবে না কিন্তু উনি শিক্ষা-সমাজ-রাজনীতি নিয়ে যেমনভাবে ভেবেছেন, যা করতে চেয়েছেন তা কিন্তু থেকে যাবে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনা সমকাল থেকে অনেক অনেক এগিয়ে ছিল। আজ বিংশ শতাব্দীর শেষে যখন আমরা একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি তখন রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-সমাজ-রাজনীতি বিষয়ক লেখাগুলি পড়ে অবাক হয়ে ভাবি উনি অতবছর আগে এমনটা ভেবেছিলেন কি করে ? উনি বলেছিলেন আমরা স্বাধীনতার উপযুক্ত হইনি, তখন অনেকের খারাপ লেগেছিল। লোকে নিন্দা করেছিল। কিন্তু আজ এই ১৯৯৭-তে দাঁড়িয়ে আমি অন্তত বিশ্বাস করি আমরা স্বাধীনতার উপযুক্ত হইনি। হলে, আজ লালুপ্রসাদ যদবরা প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য দৌড়-ঝাঁপ করছে, এ দেখতে হত না।